সূত্র মতে, গত দুই মাসের বেশি সময় ধরে দেশের রাজনীতিতে অনেকটা কোনঠাসা সরকারি দল। বিশেষ করে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি, দলীয় নেতাকর্মী হত্যার বিচার, খালেদা জিয়ার মুক্তি, নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে অনুষ্ঠিত বিএনপি বিভাগীয় গণসমাবেশগুলোতে লাখো মানুষের উপস্থিতি সরকারি দলে ভীতির সঞ্চার করেছে। সমাবেশগুলোতে লোকসমাগম আটকাতে কোথাও তিনদিন আগে, কোথাও দুই দিন আগে থেকে পরিবহন ধর্মঘট পালন করেছে তারা। এর পাশাপাশি ছিল মারধর, হুমকি ধামকি, গ্রেফতার। কিন্তু কোনো বাধাই সমাবেশের উপস্থিতি আটকানো যায়নি। ফলে আগামী ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশেও জনসমাগম আটকানো যাবে না সেটি অনেকটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। কিন্তু তারপরও সমাবেশকে যতটুকু নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়, লোক সমাগম আটকানো যায়, তার সব কিছুই করছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। এরই মধ্যে সমাবেশের স্থান নিয়ে তারা বিএনপিকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে।
বিভাগীয় শহরগুলোতে গণসমাবেশ শেষ করে পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী আগামী ১০ ডিসেম্বর রাজধানী ঢাকায় বড় জমায়েত করতে চায় বিএনপি। এই সমাবেশ নিয়েই এখন বিএনপি ও সরকারের মধ্যে শুরু হয়েছে তুমুল বাকযুদ্ধ। বিএনপির প্রচার বিষয়ক সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি বলেন, বিএনপি সোহরাওয়ার্দীতে সমাবেশের জন্য কোনো অনুমতি চায়নি। নয়াপল্টনে সমাবেশের জন্য অনুমতি চেয়েছে। কাজেই নয়াপল্টনে সমাবেশ হবে।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ১০ ডিসেম্বর নয়াপল্টনে আমাদের দলীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ হবে এবং বিএনপি এই সমাবেশ সফল করবে। সরকার দলীয় বিভিন্ন সংগঠনের সমাবেশের অনুমতি দিচ্ছে পুলিশ। তারা তাদের নির্দিষ্টস্থানে সমাবেশ করছে। কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে শর্তসাপেক্ষে কেন?
জানা গেছে, নেতা-কর্মীদের সমাবেশে উপস্থিতি নিশ্চিত করতে আগে থেকে ঢাকায় ঢুকার বার্তা দেওয়া হয়েছে। ১০ লাখ লোকের সমাগম ঘটিয়ে বিএনপি জোট শরীকদের নিয়ে ঢাকা থেকেই সরকার পতনের যুগপৎ আন্দোলনের ঘোষণা দিতে চায়। সমাবেশ থেকে বিক্ষোভ মিছিল, পথসভা, লংমার্চ, ভিন্ন আঙ্গিকে অবরোধসহ সিরিজ কর্মসূচি আসতে পারে। এই কর্মসূচির মাধ্যমে বিএনপি শরিকদের সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনের যাত্রা শুরু করবে। বিএনপি শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করতে চায় জানিয়ে নীতিনির্ধারক পর্যায়ের একাধিক নেতা বলেছেন, বাধা দিলে ‘লড়াই’ হবে।
দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এ প্রতিবেদককে বলেন, আমরা শান্তিপূর্ণভাবে বিভাগীয় সমাবেশগুলো করেছি। কোথাও আমাদের পক্ষ থেকে বিশৃঙ্খলা করা হয়নি। বরং সরকারি দলই অবরোধ, ধর্মঘটসহ এমন কিছু নেই যা করেনি। ঢাকাতেও আমরা শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি করতে চাই। আর সেটা হবে নয়াপল্টনেই। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, হেফাজতের আন্দোলন দমন করতে যে পদক্ষেপ সরকার নিয়েছিল এখন সেই অবস্থা নাই। জনগণ জেগে উঠে দাঁড়িয়েছে, এদেরকে দমন করতে পারবেন না। পরিষ্কার কথা, ঢাকার সমাবেশ হচ্ছে বিভাগীয় সমাবেশের সর্বশেষ সমাবেশ। এখান থেকে আমরা পরবর্তী সময়ের আন্দোলন কর্মসূচি নির্ধারণের পথে যাব। ঢাকার সমাবেশ চূড়ান্ত আন্দোলন কর্মসূচি নয়। আরেক প্রশ্নের জবাবে বিএনপি মহাসচিব বলেন, যাদের সঙ্গে আমরা আলোচনা করেছি’ তাদের নিয়ে যুগপৎ আন্দোলন গড়ে তোলা হবে।
বিএনপির একাধিক শীর্ষ নেতা জানান, ঢাকার মহাসমাবেশ থেকে সরকারবিরোধী এক দফার যুগপৎ আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষিত হতে পারে। এরই মধ্যে সমমনা দলগুলোর সাথে আলোচনাও শেষ হয়েছে। সবাই মিলে একসঙ্গে রাজপথে নামার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত। ঢাকার সমাবেশে সরকারি দলের আচরণের উপর নির্ভল করছে কর্মসূচির ধরনও। বাধা দেওয়া হলে হরতালের মত কর্মসূচিও আসতে পারে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ১০ ডিসেম্বর বিএনপি নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করবে। পাশাপাশি ‘নির্বাচনকালীন নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার’ দাবিতে আন্দোলনের পক্ষে থাকা সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দল ও জোটের নিজ নিজ অবস্থান থেকে অভিন্ন কর্মসূচি ঘোষণার পক্ষে বিএনপি। দলের দুজন নীতিনির্ধারক বলেন, নানা ইসুতে তারা রাজপথে কর্মসূচি পালন করে আসছে। বিভাগীয় গণসমাবেশে সারা দেশে নেতাকর্মীদের মধ্যে একটা জাগরণ সৃষ্টি হয়েছে। তারা বেশ উজ্জীবিত। নেতাকর্মীদের এ মনোবল ধরে রাখতে হবে। তাই গণসমাবেশ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সরকারবিরোধী আন্দোলনের এ ধারা অব্যাহত রাখার ব্যাপারে সবাই একমত পোষণ করেন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, ১০ ডিসেম্বরের গণসমাবেশের জন্য সরকারের অনুমতির অপেক্ষায় জনগণ নেই। সমাবেশ বিএনপি করবেই। আওয়ামী লীগ সরকারকে কীভাবে তাড়াব ১০ ডিসেম্বর কী হবে, তা ১০ ডিসেম্বরেই জানিয়ে দেব। সেদিন বলে দেব কী কী করব। তবে জানিয়ে করব। অজ্ঞাত কোনো কাজ করব না। দলের গুরুত্বপূর্ণ একাধিক নেতা জানান, আগামী ১০ ডিসেম্বর ঢাকার গণসমাবেশ বিরোধী রাজনৈতিক দলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। শেখ হাসিনার অধীনে যেসব রাজনৈতিক দল দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ইতোমধ্যে তাদের সঙ্গে বিএনপি দুই দফা বৈঠক করেছে। অন্যান্য রাজনৈতিক দলের মতামতের ভিত্তিতে অভিন্ন দাবি প্রস্তুত করা হচ্ছে। বিএনপি চাইছে, এই অভিন্ন দাবি নিয়ে মাঠে নামতে। সেক্ষেত্রে ঢাকার গণসমাবেশের দিনই তারা যুগপৎ কর্মসূচি ঘোষণার মধ্য দিয়ে মাঠে নামতে চাইছে। সে লক্ষ্যে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। জানা গেছে, ১০ ডিসেম্বরের পর থেকে বিরতিহীনভাবে আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি অর্জিত না হয়।
জানা গেছে, প্রথমদিকে যুগপৎ আন্দোলনে রাজি দলগুলোকে ১০ ডিসেম্বর গণসমাবেশ মঞ্চে উঠানোর একটা প্রস্তাব ছিল। কিন্তু বিএনপির নীতিনির্ধারকরা চাচ্ছেন, আন্দোলনের শেষদিকে এক মঞ্চে উঠতে। তার আগে নিজ নিজ অবস্থান থেকে অভিন্ন দাবি ও কর্মসূচিতে যুগপৎ আন্দোলন করবে দলগুলো। বিএনপির পক্ষ থেকে স্পষ্ট বার্তা দেওয়া হয়েছে, আগামী দ্বাদশ নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিতে চায়। কিন্তু সেই নির্বাচন হতে হবে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে। তা ছাড়া নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করবে না।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, মূলত ঢাকার সমাবেশকে কেন্দ্র করে উত্তেজনার সূত্রপাত হয় বিএনপির মধ্যম সারির কয়েকজন নেতার বক্তব্যের রেশ ধরে। গত ৮ অক্টোবর রাজধানীর সেগুনবাগিচায় এক আলোচনা সভায় ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক আমানউল্লাহ আমান বলেন, আগামী ১০ ডিসেম্বরের পরে দেশ চলবে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের কথায়। এর এক দিন পর দলের কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দীন চৌধুরী লক্ষ্মীপুরে দলীয় কর্মসূচিতে বলেন, শিগগির তারেক রহমান দেশে আসবেন। তার পরদিন দলের চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা জয়নুল আবদিন ফারুক বলেন, ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় সমাবেশ হবে ‘আটলান্টিক মহাসাগরের’ মতো। এই সমাবেশে খালেদা জিয়া যাবেন। বিভিন্ন গণমাধ্যমে আসা এ বক্তব্যগুলোকে সামনে এনে কথা বলা শুরু করেন ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রী-নেতারা।অবশ্য এমন বক্তব্য দেওয়ার ঘটনায় বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতারা কিছুটা বিব্রত হন। পরে ওই তিন নেতাকে দলের পক্ষ থেকে সতর্ক করা হয়।
বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা বলছেন, সরকার ও ক্ষমতাসীন দল ১০ ডিসেম্বর বিএনপির সমাবেশকে ঘিরে রাজধানীতে একটি ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে চাইছে। এ লক্ষ্যে ঢাকায় নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তারও শুরু হয়েছে। আর সমাবেশের দিন বিএনপিকে সতর্ক পাহারায় রাখার কথা বলেছেন আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক। তিনি বলেন, বিএনপি সমাবেশের নামে কোনো ধরনের নৈরাজ্য সৃষ্টি করার চেষ্টা করলে মতিঝিলে হেফাজতে ইসলামের যে পরিণতি হয়েছিল, এর চেয়েও খারাপ পরিণতি ভোগ করতে হবে।
সূত্র জানায়, মহাসমাবেশের কয়েকদিন আগে ঢাকার বাইরে থেকে বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী জড়ো করতে ইতোমধ্যেই সংশ্লিষ্ট দলীয় নেতাদের প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন বিএনপি হাইকমান্ড। আর আগে আসা নেতাকর্মীদের মধ্যে যাদের ঢাকায় কোনো আত্মীয়-স্বজন নেই তাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাও করা হবে। এ জন্য রাজধানীর বিভিন্ন হোটেল, কমিউনিটি সেন্টার, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ও নির্মাণাধীন বিভিন্ন ভবন প্রস্তুত রাখা হয়েছে। আর রাজধানীতে বসবাসকারী বিএনপি নেতাদের নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকা থেকে আসানেতাকর্মীদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করতে বলা হয়েছে।